বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৫৯ অপরাহ্ন
ঘোষণা:
সত্য প্রকাশে অপ্রতিরোধ্য দৈনিক সময়ের কণ্ঠ ডটকমে আপনাকে স্বাগতম  

মুরসালিনের পরিবারটি কোথায় যাবে এখন!

দৈনিক সময়ের কন্ঠ ডেস্ক
আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০২২, ৬:০৮ অপরাহ্ন

ছোট হামজার বয়স মাত্র তিন বছর। ‘বাবা-মা’ ডাক দেয়া ছাড়া স্পট কথা বলা শেখেনি। বাবা প্রতিদিন অফিস শেষ করে ‘মজা’ আনতেন। কোলে নিয়ে আদর করতেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। আর এই আদর-সোহাগ পাবে না শিশু আমির হামজা। নিউ মার্কেটের সংঘর্ষে প্রাণ গেছে তার বাবা ‘হাট বাজার’ দোকানে কর্মরত মুরসালিনের। বাড়িতে বাবার লাশ দেখে মায়ের চাপা কান্নায় হামজার মুখে স্পষ্ট শোনা যায়, ‘বাবা মজা কিন্না দিব।’ এর বেশি বলতে পারেনি শিশুটি।

হামজার বোন হুমায়রা ইমলাম লামহা। তার বসয়ও মাত্র সাত। বাবা হারানোর যন্ত্রণা বুঝে উঠতে পারছিল না সে। তবুও চোখ ছলছল করছে। কান্নাজড়িত মৃদু সুরে শিশু হুমায়রা বলছে, ‘আমার বাবা কাজে গেছিল। ওখান থেকে মানুষেরা মাইরা ফালাইছে।’

মুরসালিনের স্ত্রী অনি আক্তার মিতু। ‘স্বামীকে হারানোর বেদনায় বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন তিনি। ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দিশাহারা। কেউ তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। স্বজনরা বারবার মাথায় পানি ঢালছিলেন। ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কান্না করে মিতু বলেন, মার্কেট সমিতির লোকেরা যদি মার্কেট বন্ধ রাখতো তা হলে আমার স্বামীর যেত না। আমার স্বামী যাইয়া দুর্ঘটনা ঘটছে। এখন আমার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ কী হবে? আমার স্বামী থাকলে ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ করতো। আমি কোনো কাম করতে পারি না। কি কইরা ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ করমু? সরকারের কাছে চাই, সরকার আমার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ দেখুক। মার্কেট সমিতির লোকেরাও আমাদের সাহায্য করুক। আর কিছু চাই না।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনের মতো সে ওইদিন কাজে গেছে। ওইখানে গণ্ডগোল হইছে আমারে কেউ কয় নাই। আমার স্বামী মেডিকেলে ভর্তি হলে আমারে আরেকজন ফোন দিয়েছে। মেডিকেলে যাইয়া দেখি অবস্থা ভালো না। কে এমনভাবে মারছে। আমি তো দেহি নাই। কারে দোষ দিমু। তাগো বিচার কইরো আল্লাহ। আমার স্বামীরে তো কেউ ফেরত দিতে পারবে না।’
সন্তান মুরসালিনকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা নূরজাহান বেগম। সন্তানের লাশ দেখে আহাজারি করে বলছেন ‘ও আমার মোরসালিন। আমার বাবারে কি তোমরা আইনা দিতে পারবা? আমার বাবা পহেলা রোজার দিন আমার লগে ইফতার করছিল। কামে যাওয়ার সময় আমারে ১০০ টাকা দিয়া গেছিল। আমি বিচার চাই। আমার নিরীহ বাচ্চারে মারছে। নির্মমভাবে মারছে। দুধের শিশু থুইয়া মারছে। তারা কইতাছে বাবা আইনা দিতে। আপনারা পারবেন ওগো বাবারে আইনা দিতে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে মরদেহ নিতে আসেন বড় ভাই নুর মোহাম্মদ। মরদেহের অপেক্ষায় মাথায় হাত দিয়ে খানিক বসে থাকেন আবার মুখ আড়াল করে কান্না করেন। এ সময় মুরসালিনের বন্ধুরা বাকরুদ্ধ হয়ে অপেক্ষা করেন। নুর মোহাম্মদ বলেন, ভাইটা কীভাবে মারা গেল, কিছুই জানলাম না। এটা কেবল ও আর আল্লাহ জানেন। আমার ভাইরে হাসপাতালে যাইয়া পাইছি। আইসিইউতে ভর্তি। সেখানে তার সিচুয়েশন দেখি খারাপ। ওর শরীরে আঘাত আর ক্ষতের বাইরে আমরা আর কিছুই দেখি নাই।
মুরসালিনের বন্ধু শাওন বলেন, দুইটার দিকে ওরে হাসপাতালে নেয়া হইছে। আমরা খবর পাইয়া গেছি। যে অবস্থা দেখছি সেটা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। খুব খারাপ অবস্থা দেখছি। আমাদের ২০০৪ সাল থেকে সম্পর্ক। ছেলে হিসেবে অনেক ভালো। হঠাৎ করে দুর্ঘটনা হয়ে গেল। আমরা মেনে নিতে পারছি না। অফিস থেকে বাসায় যাওয়ার আগে প্রতিদিন আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতো। আমাদের মন খারাপ থাকলে ভালো করে দিতো। ও একদিন আড্ডায় না থাকলে আমরা বাসা থেকে খুঁজে নিয়া আসতাম। এখন ওই মজার বন্ধুটাই মারা গেল। মুরসালিনের এলাকার বড় ভাই শাকিল বলেন, সে খুব ভালো ছেলে। আমরা আশা করিনি ওর এমন অবস্থা হবে। ওর কি দোষ ছিল? সবার কাছে দাবি ওর দুইটা বাচ্চার জন্য কিছু করতে।
গতকাল ভোর পৌনে পাঁচটার দিকে ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মুরসালিন। মর্গ সূত্রে জানা যায়, আঘাতের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। এদিন বেলা একটার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে মুরসালিনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর মরদেহ রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর পশ্চিম রসুলপুর এলাকায় পরিবার কাছে নেয়ার পরেই পুরো এলাকা আহাজারিতে স্তব্ধ হয়ে যায়। এদিন বিকালে আসর নামাজের পর মুরসালিনের জানাজা সম্পন্ন করে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে গত মঙ্গলবার নিউ মার্কেট এলাকায় দোকান কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন মুরসালিন। পরে তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।
তবে এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা না হলেও আজ (শুক্রবার) মামলা করা হবে বলে মানবজমিনকে নিশ্চিত করেন মুরসালিনের বড় ভাই নুর মোহাম্মদ।
নিউ সুপার মার্কেটের হাট বাজার নামের একটি রেডিমেট কাপড়ের দোকানে কাজ করতেন মুরসালিন। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার কালাইনগর গ্রামে। তবে দীর্ঘদিন তিনি রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর পশ্চিম রসুলপুর এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে মুরসালিন দ্বিতীয়।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ.....
এক ক্লিকে বিভাগের খবর