রাস্তার পাশে রয়েছে ছোট্ট একটি দোকান। প্রায় ১২ বছর ধরে বৃদ্ধা নূর আলী খাঁ (৭৮) ও তার স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ সুফিয়া খাতুন (৭২) ছোট্ট দোকানঘরে বসবাস করেন। দোকানে প্রতিদিন যা বিক্রি হয়, তাতে তাদের সংসারও চলে না। ফলে অন্যান্য চাহিদা মেটাতে না পেরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন বৃদ্ধ এই দম্পতি।নূর আলী বয়সের কারণে ভারী কাজ করতে পারেন না। তাই মুদি ব্যবসা শুরু করেন। তার আগে তিনি দিনমজুর ও লেবুর ব্যবসা করতেন। তার চার মেয়ে ও দুই ছেলে রয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশে ছোট্ট একটি মুদি দোকান। দোকানের মেঝেতে সুফিয়া খাতুন শুয়ে রোগের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। পাশে তার স্বামী নূর আলী তার সেবা করছেন। একই সাথে দোকানদারি করছেন। দোকানে সীমিত পরিমাণে চানাচুর, বিস্কুট, পাউরুটি, কয়েল, সাবান, শ্যাম্পু, লবণ, ডালসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিস রয়েছে। সাকল্যে আনুমানিক দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকার পণ্য আছে।
প্রতিদিন তার দোকানে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকার জিনিস বিক্রি হয়। এতে তার লাভ হয় ৪০ থেকে ৬০ টাকা। এই লাভের টাকায় তাদের সংসার চলে না। ওষুধ কেনার টাকাও জোগাতে পারেন না।
শুধু তা-ই নয়, গৃহহীন হয়ে প্রায় এক যুগ ধরে তারা শৌচাগার, টিউবওয়েল, খাদ্য ও বস্ত্রের অভাবে সীমাহীন কষ্ট করছেন। কিন্তু তাদের ছেলেরা বসবাস করেন পাকা বাড়িতে। তবু তাদের সন্তানদের বিরুদ্ধে নেই কোনো অভিযোগ।
অসুস্থ ও অসহায় সুফিয়া খাতুন প্রতিবেদকে বলেন, থাকার কিছু নাই, বাড়ি নাই, জায়গা নাই, খেতে দেওয়ার লোক নাই। আমি চলাফেরা করতে পারি না, হাঁটতে পারি না। ছেলেদের অবস্থাও ভালো না। তাদের সংসারেও অভাব। আমার রোগ-যন্ত্রণা আছে কিন্তু চিকিৎসা করার ক্ষমতা নেই। চেয়ারম্যান-মেম্বার টাকাপয়সা দেয় না। ঘর চাই, বাড়ি চাই, কাপড়-চোপড় চাই, খাওয়াদাওয়া চাই, চিকিৎসার জন্য সাহায্য চাই।
শেষে বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কাছে পেলে মন খুলে পেটের কথা সব তাকে বলতাম। শেখ হাসিনাকে মায়ের মতো করে সব দুঃখ বলতাম।
এ বিষয়ে বৃদ্ধ দম্পতির ছেলে ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তারা এই প্রতিবেদকের ওপর চড়াও হন। এ সময় তারা ছবি তুলতে ও তথ্য সংগ্রহ করতে বাধা দেন। কোনো বক্তব্য দেবেন না বলে জানিয়ে দেন বৃদ্ধা দম্পতির ছেলে মাহাতাব উদ্দিন।
পরে ছেলেদের ভয়ে নূর আলী খাঁ দোকানের পেছনে নিয়ে প্রতিবেদককে বলেন, আমার স্ত্রী অনেক বছর আগে থেকে অসুস্থ। প্রথমের দিকে চিকিৎসা চালিয়েছিলাম। পরে টাকার অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে না পারায় সে ছয় বছর ধরে পঙ্গু, একা একা চলাচল করতে পারে না। তা ছাড়া নানা জটিল ও গোপন রোগে আক্রান্ত আমার স্ত্রী। আমিও নানা রোগ ও বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ। আমরা টাকার অভাবে খেয়ে না খেয়ে দিন যাপন করি। আমার কিছুই নেই। দুই শতক জমি ছিল, সেখানে ছেলেরা বাস করে। আমি টাকার অভাবে দোকানে মালপত্র তুলতে পারি না। ৩০০ থেকে ৬০০ টাকার বিক্রি হয়, তাতে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৬০ টাকা লাভ হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন প্রতিবেশী বলেন, বৃদ্ধ দম্পতির ছেলেরা চাইলে তার মা-বাবাকে তাদের বাড়িতে রাখতে পারে। কিন্তু বাড়িতে তাদের জায়গা দেয় না। কয়েক মাস আগে থেকে দুবেলা-দুমুঠো খাবার খেতে দেয়। কিন্তু বৃদ্ধ-বৃদ্ধার চিকিৎসা, বাসস্থান, বস্ত্রসহ নানা কষ্ট দেখার কেউ নেই।
এ বিষয়ে কথা বলতে খলিসাকুন্ডি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জুলমত হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
স্থানীয় ইউপির ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সেলিম বিন জামান বলেন, বৃদ্ধ দম্পতির ঘর নেই, এ জন্য দোকানে বসবাস করেন। বিষয়টি আমি জানি। আমি এবারের নবনির্বাচিত সদস্য। সরকারি বিধিমোতাবেক বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় সার্বিক সহযোগিতা করার চেষ্টা করব। তবে তার ছেলে অবস্থা মোটামুটি ভালো।
দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল জব্বার বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আপনার মাধ্যমে বৃদ্ধ দম্পতির মানবেতর জীবনযাপনের বিষয়টি জানলাম। আমি খোঁজখবর নিয়ে সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নেব।